উপ-সম্পাদকীয়
“আমাদেরকে যোগ্যতা ও কর্মানুযায়ী ৮ বছরে পদোন্নতি দেওয়া হয় না, ১২ বছরে পদোন্নতি দেওয়া হয় না, ১৫ বছরে আমাদের একই গ্রেডে রাখা হয়েছে, ২৫ বছরেও আমাদের কপালে পদোন্নতি জুটেনি। সবচেয়ে ভয়ংকর,আমি কত বছর একই পদে থাকবো তার সুনির্দিষ্ট কোন বিধি নেই। তাহলে এই রাষ্ট্রের সংবিধানের ২০ নং অনুচ্ছেদের কাজ কি?”
পদোন্নতি সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গুলোর মধ্যে যে দপ্তরকেন্দ্রিক বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর তা বাংলাদেশের সরকারি চাকুরির নিয়োগ পদ্ধতি ও পদোন্নতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বৈষম্য গুলোর মৌলিক কারন ক্যাডারের সাথে বিভিন্ন দফতরের পদবীকে নন ক্যাডার শব্দটি দিয়ে ট্যাগ দেওয়া এই ধরনের বৈষম্যমূলক ট্যাগের শিকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক হাজারের বেশি সমাজসেবা অফিসার। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার একটি অংশে বলা হয়েছে, আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।
অঙ্গীকারের প্রতিটি লাইনের প্রকৃত স্পিরিট থেকে একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমরা বঞ্চিত কারণ গত ৪১ বছরে পদোন্নতি ও সুযোগ সুবিধায় সাম্য ও সুবিচারের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য কোন ন্যায্য নিয়োগবিধি তৈরি হয়নি। জবাব আছে কি? সুযোগের সমতার কথা এভাবেই উল্লেখ আছে সংবিধানের ১৯৷ (১) অনুচ্ছেদে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন৷ও (২)নং অনুচ্ছেদে, মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷সংবিধানের এই ধারা অনুযায়ী তুলনামূলক ভাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের হাজারো কর্মকর্তা সুযোগের সমতা থেকে বঞ্চিত।
আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বিলোপ করার জন্য এই রাষ্ট্র সুষম সুযোগ ও সুবিধা থেকে তুলনামূলক ভাবে আমাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে । জবাব আছে কি? অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্মের কথা সুস্পষ্ঠ করে বলা হয়েছে ২০৷ (১) কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন৷ (২) রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক-সকল প্রকার র্শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে৷২০ (১)নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমাদের চাকুরি কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও,সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের নিকট আমাদের সম্মানিত করার অধিকার থেকে এই রাষ্ট্র বঞ্চিত করছে।
আমাদেরকে যোগ্যতা ও কর্মানুযায়ী ৮ বছরে পদোন্নতি দেওয়া হয় না, ১২ বছরে পদোন্নতি দেওয়া হয় না, ১৫ বছরে আমাদের একই গ্রেডে রাখা হয়েছে, ২৫ বছরেও আমাদের কপালে পদোন্নতি জুটেনি। সবচেয়ে ভয়ংকর,আমি কত বছর একই পদে থাকবো তার সুনির্দিষ্ট কোন বিধি নেই। তাহলে এই রাষ্ট্রের সংবিধানের ২০ নং অনুচ্ছেদের কাজ কি? ২০(২) ধারা অনুযায়ী বুদ্ধিবুত্তিমূলক প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং সমাজে আমাদের মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশে নানা বৈষম্য সৃষ্টি করে সাংবিধানিক এই অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে ও হচ্ছে।সংবিধানের ২৮। (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্র সরকারি চাকুরিজীবীদের মধ্যে একপাক্ষিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই সংবিধানের “গোষ্ঠী “শব্দটিকে সুস্পষ্ট ও হাইলাইট করেছে যা সমাজে স্বভাবতই সরকারি চাকুরির তুলনামূলক কয়েকটি পেশার চাকুরীজীবীর মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছে। যার কারনে আমরা তুলনামূলক ভাবে পদোন্নতি সহ নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। ২৯। (১) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ঠ ভাবে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে কিন্তু যুগের পর যুগ পদ লাভের সুযোগের ন্য্যাতা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। ১৪০। (২) (ক) বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়-প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদান, উক্ত কর্মের এক শাখা হইতে অন্য শাখায় পদোন্নতিদান ও বদলিকরণ এবং অনুরূপ নিয়োগদান, পদোন্নতিদান বা বদলিকরণের জন্য প্রার্থীর উপযোগিতা-নির্ণয় সম্পর্কে অনুসরণীয় নীতিসমূহ। প্রশ্ন হচ্ছে এই সকল কাজ করতে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হয়েও সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল স্পিরিট, ১৯(১) সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য হিসেবে কর্ম ২০(১),(২), ২৮(১),২৯(১) অনুচ্ছেদে বর্নিত ধারাসমূহের বাস্তবায়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজসেবা অফিসারদের জন্য কতটুকু ন্যায্যতা নিশ্চিত করেছে? এই ন্যায্যতার দাবি করলে শাস্তিমূলক বদলিসহ নানা ধরণের হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নিশ্চয়ই ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার নতুন বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের আদর্শের পরিপন্থী। কাজ করলে ভুল হবে, সমালোচনা থাকবে, পৃথিবীর এমন কোন কাজ নেই তার সমালোচনা বের করা যাবে না,তাই বলে রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী ও নাগরিক হিসেবে আমাদের উপরিউক্ত সাংবিধানিক অধিকার গুলোর দাবি ও নিশ্চিত করার অধিকার থাকবে না?
লেখক- উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, পীরগাছা, রংপুর।