ঢাকার ব্যস্ত পোশাক কারখানায় মেশিনের শব্দে ডুবে থেকেও তাওহীদ মিয়ার কানে ভেসে আসত সংসারের অভাব-অভিযোগ। ছয় হাজার টাকার বেতনে কোনো রকমে দিন চললেও হারিয়ে যাচ্ছিল প্রিয়জনদের মুখের হাসি। স্ত্রী শিমুর চোখে লেগে থাকত দুশ্চিন্তার ছাপ। সব মিলিয়ে ভেতরে-ভেতরে ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, এভাবে আর নয়। সাহস করে ফিরে এলেন গ্রামে। হাতে নিলেন নতুন স্বপ্ন- মাটি ছাড়া চারা উৎপাদন। সেই ছোট স্বপ্নই এখন তাঁকে দিয়েছে নতুন আলো, নতুন জীবন। যাঁর সংসারে একসময় তিনবেলা ভাতের নিশ্চয়তা ছিল না, সেই তাওহীদ এখন মাসে আয় করছেন ৮০ হাজার টাকা আর কাজ দিচ্ছেন গ্রামের ১৮–২০ জন মানুষকে।
পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মিলনপুর গ্রাম। সেখানেই তাওহীদের জন্ম। কাঁচা-পাকা সড়ক ধরে গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়ে নানান সবজির খেত। প্রতিটি বাড়িতে হাঁস, মুরগি, ছাগল ও গাভি। পতিত জমিতে শাকসবজির বাগান। কৃষক-কৃষাণী ব্যস্ত মাঠে। কেউ পরিচর্যা করছেন, কেউ তুলছেন সবজি। তাওহীদের খোঁজ করতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা দেখিয়ে দেন- তাঁর বাড়ির পাশের নার্সারিতে বসে আছেন তিনি। সেখানেই বসে শোনালেন তাঁর সফলতার গল্প।
তাওহীদ জানান, ১৯৯১ সালে তাঁর জন্ম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবার সামান্য জমিতে কষ্টে চলত সংসার। ২০০৭ সালে এসএসসি পাসের পরই কর্মজীবনে ঢুকে পড়তে হয় তাঁকে। ২০১০ সালে পাশের গ্রামের শিমু বেগমকে বিয়ে করেন। সংসারের খরচ বাড়তেই ঢাকায় পাড়ি জমান। সোয়েটার কারখানায় চাকরি করেছেন দুই বছর। কিন্তু ছয় হাজার টাকার বেতনে সংসার চলে, স্বপ্ন পূরণ হয় না। অভাব ঘনিয়ে আসতেই ভাবলেন-জীবন বদলাতে হলে ভিন্ন কিছু করতে হবে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চাকরি ছেড়ে চূড়ান্তভাবে ফিরে এলেন গ্রামে।
২০১৪ সালের মে মাসে বেসরকারি একটি সংস্থার উদ্যোগে মাত্র আট দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। বিষয় ছিল- মাটি ছাড়া সবজির চারা উৎপাদন। শিখলেন, কীভাবে নারকেলের ছোবড়া, কচুরিপানা, গোবর ও কিছু রাসায়নিক সার মিশিয়ে তৈরি করা যায় ‘কোকোপিট’। সেটাই হলো তাঁর ভাগ্য ঘুরিয়ে দেওয়ার মূল উপাদান। ওই বছরের জুনে মাত্র ১০ শতক জমিতে তৈরি করলেন প্রথম নার্সারি। উৎপাদন করলেন এক লাখ সবজির চারা। তিন মাসেই সব বিক্রি হয়ে গেল। আয় হলো ৬০ হাজার টাকা। তাওহীদ বুঝলেন, পথ তিনি ঠিকই বেছে নিয়েছেন। এখন তাঁর দেড় একর জমিজুড়ে বিস্তৃত নার্সারি। মরিচ, বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, পেঁপে, ফুলকপি, বাঁধাকপি- আরও নানা সবজির চারা তৈরি হয় সেখানে।
তাওহীদ জানান, তাঁর মাসিক আয় এখন গড়ে ৮০ হাজার টাকা, বছরে প্রায় ৯ লাখ টাকা। তাঁর নার্সারিতে প্রতিদিন কাজ করছেন ১৮-২০ জন নারী-পুরুষ। নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পাশাপাশি তিনি ঘুরিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের আরও অনেকের ভাগ্য। এই আয়ে তিনি কিনেছেন জমি, বাড়িয়েছেন গাভি ও ছাগলের পাল। দুই ছেলে সামিউল ও আব্দুল্লাহকে স্কুলে পড়াচ্ছেন। সংসারে এখন শুধু স্বস্তি নয়, আছে স্বপ্নপূরণের আলোও।
পীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহজাহান সরদার বলেন, তাওহীদ একজন সফল মডেল কৃষক। মাটি ছাড়া চারা উৎপাদন পদ্ধতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে চারা মাটিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকে, ফলে ফলনও বেশি হয়। তাঁর উদ্যোগ অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
তাওহীদ মিয়া বলেন, ‘প্রথমে অনেকেই সন্দেহ করত- এই চারা হবে তো? কিন্তু আজ আমার নার্সারি থেকে হাজার হাজার কৃষক চারা নিয়ে যাচ্ছেন। আমি চাই, গ্রামের আরও তরুণ বেকার বসে না থেকে নতুন কিছু করার সাহস দেখাক। অভাব একদিন না একদিন জয় হবেই।’