দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সম্প্রতি শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা কারণে এক প্রভাবশালী নেতাকে শোকজ করার পর এবার চাঁদাবাজির অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানার তিন নেতাকে গ্রেফতারের বিষয় সামনে এসেছে। এনসিপি সূত্রে জানা গেছে, এই তিন নেতার বিরুদ্ধে দ্রুতই দলীয় শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দলের শীর্ষ নেতাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা কারণে শোকজ করা হয়েছে। কারও কারও পদও বাতিল করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজির ঘটনায় ধরা পড়া তিন নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সেই ধারাবাহিকতার অংশ। এনসিপি জানিয়েছে, দলের নীতি ও শৃঙ্খলা লঙ্ঘন বরদাস্ত করা হবে না।
গত ছয় মাসে শৃঙ্খলাভঙ্গ, নৈতিক স্খলন ও বিতর্কে জড়িত ১০ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এই নেতাদের মধ্যে পাঁচজনই রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য।
শোকজপ্রাপ্ত হলেন যেসব নেতা:
গত ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে কক্সবাজার সফর করা শীর্ষ নেতাদের কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেয় এনসিপি। হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, ডা. তাসনিম জারাদেরও নোটিশ দেওয়া হয়। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এই সফর সম্পর্কে দলের রাজনৈতিক পর্ষদকে পূর্বে অবহিত না করার কারণে তাদেরকে শোকজ করা হয়। তবে, পরবর্তীতে তাদের দেওয়া ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হওয়ায় এনসিপি নেতৃবৃন্দ শোকজ নোটিশগুলো প্রত্যাহার করেন এবং বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানানো হয়। এর আগে গত ১৭ জুন নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগে সারোয়ার তুষারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় এনসিপি। পরবর্তীতে তাকে দুই মাসের জন্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা হয়। ওই সময় তিনি দলের কোনো কার্যক্রমে অংশ নেননি। দুই মাস পর ২৩ আগস্ট এনসিপি শোকজ নোটিশ প্রত্যাহার করে তাকে পুনরায় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়।
এছাড়াও, সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ছিল ধানমন্ডিতে সমন্বয় পরিচয়ে মব সৃষ্টি করা কয়েকজনের কর্মকাণ্ড নিয়ে। গত মে মাসে সমন্বয়ক পরিচয়ে মব (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) সৃষ্টির ঘটনায় পুলিশ তিন ব্যক্তিকে আটক করে ধানমন্ডি থানা নিয়ে যায়। পুলিশ কাছে মুচলেকা দিয়ে ওই তিন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে আনেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। এ ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েন হান্নান মাসউদ। তাকে এনসিপি থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তিনি লিখিত জবাব দেওয়ার পর গত ২৯ মে এনসিপি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, হান্নান ভুল স্বীকার করেছেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না বলে দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। হান্নানের ওপর আরোপিত কারণ দর্শানো নোটিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে এনসিপি।
মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজি:
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাতে মোহাম্মদপুর থানায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ৫ জন গ্রেফতার হয়। এ ঘটনায় ৩ জন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঢাকা মহানগর মোহাম্মদপুর থানার যুগ্ম সমন্বয়কারী আব্দুর রহমান মানিক, হাবিবুর রহমান ফরহাদ ও মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। এছাড়াও, সাইফুল ইসলাম রাব্বি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মোহাম্মদপুর থানার সাবেক আহ্বায়ক। তার বিরুদ্ধে একাধিক চাঁদাবাজির অভিযোগসহ চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। এনসিপি নেতাদের সঙ্গে তিনিও চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার হন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী রফিক বলেন, চাঁদাবাজির ঘটনায় রাতে সেনাবাহিনী এসে পাঁচ জনকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে যায়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি চাঁদাবাজি মামলা করে। আমরা আসামিদের আজকে আদালতে পাঠিয়েছি।
স্থানীয়রা জানান, সাইফুল ইসলাম রাব্বি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার বিক্রি করে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করত। এর আগে মোহাম্মদপুর থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনা ছাড়াও, রাব্বির নেতৃত্বে গত ১৯ মে রাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে হাক্কানী পাবলিশার্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার বাসা ঘেরাও করে। সে ঘটনায় তাকে গ্রেফতারের পর হান্নান মাসউদ এসে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে কারও জায়গা দখল করে দেবে, কারও দোকানপাট দখল করে দেবে, কাউকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা আদায় করা ছিল তার মূল কাজ।
ঘটনার বিবরণ:
গত ২০ সেপ্টেম্বর বসিলা সিটি হাউজিং এলাকায় সেইফ হাসপাতাল নামের একটি হাসপাতালে মৃত শিশু জন্ম নেয়। মৃত শিশু মারা যাওয়ার ঘটনায় শিশুর পরিবারের সদস্যরা হাসপাতাল থেকে নিয়ে রায়ের বাজার কবরস্থানে শিশুকে দাফন করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকজন বিভিন্ন পরিচয়ে এসে আমার ছেলের কাছে প্রথমে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এরপর আমাদের হাসপাতাল ভাঙচুর করলে আমার ছেলে ভয়ে তাদের ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দেয়। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন সময় চাঁদার ৩ লাখ টাকার মধ্যে বাকি টাকা চেয়ে বারবার ফোন দিত। এক পর্যায়ে আমরা ফোন না ধরায় গতকাল (রোববার) সন্ধ্যায় কয়েকজন মিলে এসে চাঁদা চেয়ে মব তৈরি করে। ওই সময় আমি কোনো উপায় না পেয়ে সেনাবাহিনীকে ফোন করলে তারা এসে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমি রাতেই মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি।
অভিযুক্তদের বিষয়ে যা বলছে এনসিপি:
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, আমাদের দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে আমরা শোকজ করেছি। এছাড়াও, যারা বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়েছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। গতকাল রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) মোহাম্মদপুর থানায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের শৃঙ্খলা কমিটির কাছে অভিযোগ এসেছে। আমরা খুব দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি, যারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হব।