


রংপুরের পীরগাছার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হক সুমনের বিরুদ্ধে আশ্রয়ণ প্রকল্প, টিআর, কাবিটা, কাবিখা ও উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। গতকাল বুধবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবু সাঈদ। তিনি বলেন, সাবেক ইউএনও নাজমুল হক সুমন ও পিআইও আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মঙ্গলবার থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর আগে গত ২৫ জুন ‘পীরগাছায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি, ইউএনও’র ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ’ শিরোনামে দৈনিক সকালের বাণী পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের পরপরই দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তর নড়েচড়ে বসে।
গত ১০ জুলাই দুদক রংপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল শল্লারবিল আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেলেও, গত সাড়ে তিন মাসে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি মেলেনি। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, এ সুযোগে সাবেক ইউএনও নাজমুল হক সুমনসহ সংশ্লিষ্টরা তদন্ত বন্ধে দেনদরবার অব্যাহত রেখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের শল্লার বিলে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৪৩০টি ঘর নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুরু থেকে সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) ও বর্তমানে ঠাকারগাঁওয় জেলার এডিসি নাজমুল হক সুমনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। গত ৫ আগস্টের পরেও আওয়ামী লীগের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর একান্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত নাজমুল হক সুমন সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অনিয়ম চালিয়ে যান। এতে তাকে সহযোগিতা করেন অন্নদানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান সংগ্রাম। তার মাধ্যমে সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে নাগরিক সুবিধা ছাড়াই শল্লারবিলে দায়সারাভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৩০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। পুনর্বাসিতদের জন্য নাগরিক সেবা কমিউনিটি সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ-মন্দির ও কবরস্থান, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মক্তব, খেলার মাঠ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তাসহ কিছুই নেই।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় ৪৩০টি ঘর নির্মাণের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে পীরগাছায়। প্রতি ঘর তৈরিতে বরাদ্দ হয় তিন লাখ চার হাজার টাকা। প্রথম অবস্থায় ১১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। পরে ২০২৪ সালের শেষের দিকে বাকি ৩২০টি ঘর নির্মাণ শুরু হয়। প্রতিঘর থেকে নিম্নমানের কাজের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ টাকা করে মোট চার কোটি ৩০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পটির ৩২০টি ঘর নির্মাণকাজ শুরুর আগে সেখানে ৫-৬ ফুট উঁচু করে মাটি ভরাটের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৫৬৬ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাবিখা প্রকল্পে শ্রমিক দিয়ে মাটি ভরাটের নিয়ম থাকলেও করা হয়েছে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে।
তবে দেড় থেকে তিন ফুট উঁচু করা হয়েছে। যা বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনোভাবেই ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। এর পরেও তারা আশ্রয়ণ প্রকল্পকে ঝুঁকিতে ফেলে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেছেন। এতে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রকল্পস্থলে ড্রেজার মেশিন দিয়ে গভীর খনন করে অতিরিক্ত মাটি কেটে জমিয়ে রাখা হয়। পরে প্রায় চার কোটি টাকার মাটি বাইরে বিক্রি করেন ইউএনও নাজমুল হক সুমন। এতে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতিমধ্যে ভাঙন কাছাকাছি চলে এসেছে। এরই মধ্যে তাসনিম ও কহিনুর বেগমসহ চারজন মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদেরকে প্রকল্প সীমানার বাইরে দাফন করা হয়েছে। অনেকের কবুলিয়ত সম্পাদন হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২ কক্ষবিশিষ্ট সেমিপাকা একক ঘর নেই। প্রকল্পটিতে করা হয়েছে বহুমুখী অনিয়মের মাধ্যমে। পানীয়জলের সমস্যায় ভুগছে আশ্রিতরা। ১০টি পরিবার মিলে একটি নলকূপের পানি পান করতে হচ্ছে।
এছাড়া ঘর বরাদ্দে সুবিধাভোগীদের কাছে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে ইউএনও’র বিশেষ টোকেন ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ইউএনও। দুদক রংপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমরা অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি। ঘর নির্মাণের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অধিকতর তদন্তের জন্য প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। অনুমোদন পেলে অধিকতর তদন্ত শুরু হবে। এদিকে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে টিআর (টেস্ট রিলিফ), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পের কাজ না করেই বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সাবেক ইউএনও নাজমুল হক সুমন ও পিআইও আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে প্রকল্প প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকলেও ‘কাজ শেষ হয়েছেথ দেখিয়ে বিল তোলা হয়েছে। বরাদ্দের টাকার বেশির ভাগ ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি স্থানীয় লোকজন এসব প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানেন না। জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের যোগসাজশে একের পর এক বরাদ্দ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
সরেজমিনে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পীরগাছা উপজেলা পরিষদের রেজুলেশনে পারুল ইউনিয়নের তিনটি স্থানে গণশৌচাগার নির্মাণের জন্য ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব শৌচাগারের কোনো অস্তিত্ব নেই! ইটাকুমারি ইউনিয়ন পরিষদের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য ১ লাখ ৬৪ হাজার ১০০ টাকা ব্যয়ে আইপিএস, মনিটার ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে শুধু ছয়টি ক্যামেরা এসেছে, যা এখনো কার্টুন বন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারি প্রকল্পের নামে শুধু টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। আমরা কিছুই পাইনি!’ স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের টাকায় জনগণের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন না করে কিছু ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের জন্য ‘প্রেস্টিজথ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। মহিষমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ১০০ মিটার কাঁচা রাস্তা রেখে ছাত্রলীগ নেতা আল নাহিয়ান অভির বাড়ির উঠান পর্যন্ত পাকা রাস্তা করা হয়েছে! অথচ দুই পাশের রাস্তা কাঁচা রয়ে গেছে।
কল্যাণী ইউনিয়নের তরুণীর ভিটা কবরস্থান ও তৈয়ব মৌজার বালাচাটা হাফিজিয়া মাদ্রাসার নামে প্রকল্প বরাদ্দ দেখানো হলেও, বাস্তবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুমন মির্জা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বালাচাটা হাফিজিয়া মাদ্রাসা বলে কিছু নেই! তাহলে এই টাকার গন্তব্য কোথায়?’ সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির মদদপুষ্ট হওয়ায় প্রকাশ্যে অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নাজমুল হক সুমন পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর থেকে সরকারি পরিপত্র ও আদালতের আদেশ অমান্য করে তৎকালীন সরকার দলীয় নেতাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন। এমনকি নিজে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পরেও পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, গত সরকারের সময় দলীয় প্রকল্পের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়ে তিনি নিজে ফায়দা লুটিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুসবাণিজ্য ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্পের পুরো টাকা লুটপাট করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুস ছালাম বলেন, ‘ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও ইউএনও মিলে কোটি কোটি টাকা মেরে খেয়েছে এসব দুর্নীতির তদন্তপূর্বক বিচার করতে হবে। অবিলম্বে দুর্নীতির তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা। একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, ‘সরকার কি এসব দেখেও নীরব থাকবে। জনগণের টাকা লুটকারীদের কি বিচার হবে না। ইউএনও নাজমুল হক সুমনের বদলির আগেই অফিস সহকারী রেজাউল করিমকে বদলি করা হয়। কিন্তু নাজমুল হক সুমনের বদলির পরেও প্রায় দেড় মাস রাতে নিয়মিত অফিস করেন রেজাউল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ইউএনও’র দুর্নীতির ফাইল ঠিক করতেই রাতের আধারে নিয়মিত অফিস করেছেন অফিস সহকারী রেজাউল করিম। পীরগাছার তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ বলেন, প্রকল্পগুলো ইউএনও নাজমুল হক সুমনের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, ওই সময় আমি এখানে কর্মরত ছিলাম না। আমি পরে এখানে এসেছি। অভিযুক্ত পীরগাছার সাবেক ইউএনও ও ঠাকুরগাঁও জেলার এডিসি নাজমুল হক সুমনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বর্তমান ইউএনও শেখ রাসেল বলেন, মঙ্গলবার বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।