লাইফস্টাইল

স্বাদ ও তৃপ্তিতে মুগ্ধ ক্রেতা দিনে বিক্রি ৬ মণ জিলাপি

রবিউল আলম বিপ্লব,পীরগাছা   গাইবান্ধা

০১ মার্চ ২০২৪


| ছবি: 

খোলাবাজারে চৌকিতে বসে একটি দোকান। নেই দোকানের কোন নাম। সেই দোকানেই জিলাপি কিনতে রীতিমতো লাইনে দাঁড়ায় লোকজন। কড়াই থেকে জিলাপি তোলার ফুরসত পান না কারিগর। ক্রেতা সামলাতে হিমশিম অবস্থা দোকানের মালিক জাহিদুল ইসলামের। নামহীন এই দোকানের জিলাপির সুনাম তিন প্রজন্ম ধরে। সেই ষাটের দশক থেকে বংশ পরমপরায় সুনামের সঙ্গে জিলাপি বিক্রি করে আসছেন তারা। প্রথমে দাদা, পরে বাবা, এখন নিজেই দোকান পরিচালনা করছেন জাহিদুল ইসলাম। জিলাপির দোকানটি সপ্তাহে দুদিন রবিবার ও বৃহস্পতিবার বসে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের কাঠগড়া হাটে এবং মঙ্গলবার ও শুক্রবার জামালহাটে। দোকানটিতে গড়ে দৈনিক ৬ মণ জিলাপি বিক্রি হয়। দূর দূরান্ত থেকে এসে জিলাপি প্রেমিরা তার দোকানে ভীড় জামায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোলাবাজারে জিলাপির দোকানটির যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে। জাহিদুল ইসলামের দাদা গোলাপ হালাই কুড়িগ্রামের চিলমারী থেকে এসে তালুক ফলগাছা (ব্রীজ মোড়) গ্রামে আশ্রয় নেন। তখন থেকেই জিলাপি তৈরি করে হাটে হাটে বিক্রি শুরু করেন। এই জিলাপি বিক্রির টাকা দিয়েই এখানে স্থায়ী নিবাস গড়েন। ১৯৭৯ সালে গোলাপ হালাইয়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে ওমর আলী দোকানের হাল ধরেন। বাবার সঙ্গেই নিয়মিত দোকান করতেন জাহিদুল ইসলাম। ২০১৫ সালে বাবা ওমর আলীর মৃত্যুর পরে একাই দোকানটি চালাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে অনেক কারিগর বদল হলেও মান ধরে রেখেছেন জাহিদুল ইসলাম। তাই স্বাদেও কোনো হেরফের নেই। 
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাঠগড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে বসে জিলাপি বিক্রি করছেন জাহিদুল ইসলাম। পাশেই জিলাপির প্যাঁচ দিচ্ছেন কারিগর রাসেল হালাই। তাকে সহযোগীতা করছেন রাকিব। 
তার দোকানে গুড়ের তৈরি এবং চিনির তৈরি জিলাপি বিক্রি করছেন। যার যেটা পছন্দ ক্রেতা সেটাই খাচ্ছেন। কেউ আবার বাড়িতেও নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় জাহিদুল ইসলাম বলেন, সেই ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে দোকানদারি করে আসছি। ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। এরপর আর পড়াশুনা করতে পারিনি। তবে জিলাপির দোকান করে আমার পরিবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাই জীবনের বাকিটা সময়ও এই দোকানেই কাটিয়ে দিতে চাই। এত সুস্বাদু জিলাপি কীভাবে তৈরি করেন—জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম বললেন, আসলে এখানে তেমন কোন কেরামতি নেই। মহাজন যদি চান, তাহলেই খাবার সুস্বাদু হবে। এ জন্য লাভের আশা কম করতে হবে। আমি শুধু গুড় দিয়ে জিলাপি বানানোর চেষ্টা করি। এতে লাভ কম হলেও বিক্রি বেশী হয়। তবে শুধু গুড় দিয়ে জিলাপি বানালে ক্রেতারা নানা প্রশ্ন করেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, শুধু গুড় দিয়ে জিলাপি বানালে রং একটু কালো হয়। যা অনেক ক্রেতা বুঝতে চান না। তাই সেই ক্রেতাদের কথা বিবেচনা করে হালকা চিনি মেশানো হয়। এতে জিলাপির রং লাল হওয়ায় ক্রেতা আকৃষ্ট হয়।
শুধু জিলাপি বিক্রি করেই তার পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুড়িয়েছেন বলে জানান জাহিদুল ইসলাম। জিলাপি বিক্রির টাকায় জমি কিনেছেন। পাকা বাড়ি করেছেন। রয়েছে গরু ও মাছের খামার। ধান ও কলা আবাদ করেছেন প্রায় ১০ বিঘা জমিতে।
ছোট থেকে বড় সব বয়সের মানুষের প্রিয় খাবার জিলাপি। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর জিলাপির দাম একটু চড়া। তবুও জাহিদুলের দোকানের জিলাপি খেতে ক্রেতাদের ভীড় লেগেই আছে। স্কুলের বাজার থেকে জিলাপি খেতে এসেছেন এরশাদ আলী। তিনি অনেক পুরাতন ক্রেতা। তিন টাকা কেজিতে যখন জিলাপি বিক্রি হতো তখন থেকে তিনি এখানে জিলাপি খেতে আসেন। তিনি বলেন, তিন টাকা কেজি দরে প্রথম জিলাপি খেয়েছি এই দোকানে। এখনও প্রতিহাটে খেতে আসি। এখানকার জিলাপি সুস্বাদু, খেতেও মজা। ফলগাছা থেকে আসা আরেক ক্রেতা শাহ আলম কিরণ বলেন, দাদার হাত ধরে জামাল হাটে এসে এই দোকানে জিলাপি খাওয়া শুরু। তারপর থেকেই মন চাইলেই খেতে আসি। ভেজালের ভীড়ে জাহিদুল এখনও জিলাপির মান ধরে রেখেছে। তাই এখানে ক্রেতা সমাগম বেশী। ঐতিহ্যবাহী এই দোকানে জিলাপি কিনতে এসেছেন আব্দুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমার বর্তমান বয়স ৬৫। সেই ২০ বছর বয়স থেকে এই দোকানে জিলাপি খেয়ে আসছি। আমার পরিবারের লোকজনও এই দোকানের জিলাপি পছন্দ করে। 

জিলাপি খেতে আসা রশিদ, আজিজুল ইসলাম ও আব্দুস ছালাম জানান, শীতের দিনে জিলাপি খেতে খুবই মজা। অন্য সময় এমন মজা লাগে না, তাই মাঝে মধ্যে আমরা দল বেধে জিলাপি খেতে চলে আসি।
এখন শুধু শীতকালে নয়, সারাবছরই জিলাপির চাহিদা থাকে বলে দাবি করলেন জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ধান কাটামাড়াই শুরু হলে জিলাপির চাহিদা বাড়ে। সেটি গরম, ঠান্ডা যেটাই হউক না কেন।
তার দোকানে বর্তমানে ১৫০ টাকা কেজি দরে জিলাপি বিক্রি হচ্ছে। সামনে রমজান মাস। এ সময় বেচাবিক্রি কয়েকগুন বেড়ে যাবে। তবে তিনি অন্য ব্যবসায়ীদের মতো তার জিলাপির দাম বাড়াবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রমজান মাসে জিলাপির চাহিদা বেড়ে যাবে। কিন্তু আমি আগের দামেই বিক্রি করবো।

42