ইতিহাসের মোড় ঘোরানো আন্দোলন ‘জুলাই বিপ্লবের’ প্রায় পাঁচ মাস পর এই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আসছে। আগামীকাল মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আয়োজনে দেড় থেকে আড়াই লাখ মানুষের সমাগম হবে বলে আশা করছেন আয়োজকরা। সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) বিকেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা জানিয়েছেন সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ।
আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘আগামীকাল (মঙ্গলবার) বড় আনন্দ বয়ে আনবে। তাদের নতুন স্বপ্ন দেখাবে।’
কী থাকবে ঘোষণাপত্রে এমন প্রশ্নের জবাবে মাসউদ বলেন, ‘৩ আগস্টের এক্সটেন্ডেড ভার্সন আগামীকাল হতে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্টের পতনের পর নতুন প্রক্লেমেশন দিয়ে সেটাকে আমরা জাতির কাছে ডকুমেন্টেড করে তুলতে চাচ্ছি।’
আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘মঙ্গলবারের ঘোষণাপত্রে এমন একটা সীমারেখা আগামী দিনের সরকারকে দিয়ে যাওয়া হবে, তার বাইরে যেন কোনো সরকার যেতে সাহস না করে। বস্তাপচা রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে ১ জানুয়ারি থেকে নতুন রাজনীতির উদ্ভব হবে দেশে। সেই রাজনীতি কিসের ওপর ভিত্তি করে হবে সেটা আগামীকাল ডকুমেন্ট আকারে প্রকাশ করতে যাচ্ছি।’
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম এই সমন্বয়ক বলেন, ‘বাহাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের সকল সরকারই সীমারেখা অতিক্রম করেছে। মানুষের অধিকার হরণের সীমারেখা যাতে কেউ অতিক্রম করতে না পারে সেটা ভবিষ্যতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তাদের জন্য চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শক্তির পক্ষ থেকে সীমারেখা আমরা টানতে চাচ্ছি।’
আলোচনায় জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা
এদিকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের কর্মসূচি ঘিরে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে এটাকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ বলে মন্তব্য করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গত শনিবার ওই কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যে অনুষ্ঠানে ‘৭২এর সংবিধানের কবর রচনা’ করা হবে বলে নেতারা দাবি করেছেন।
এদিকে, রোববার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তরফ থেকে বলা হয়, ৩১ ডিসেম্বরের কর্মসূচি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’।
এখন সরকারের দিক থেকে আসা ওই বক্তব্যে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলছেন, মঙ্গলবারের কর্মসূচিটি সরকারের সহায়তায় হচ্ছে না ঠিকই, তবে তারা মনে করেন জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে তাদের ঘোষণাপত্রটি হবে ভবিষ্যৎ জাতীয় রাজনীতির জন্য নির্দেশক ও বিশেষ গুরুত্ববাহী।
অবশ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ওপর যে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল- তাএখন বিভিন্ন কারণে কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়াও আন্দোলন সফল হওয়ার পাঁচ মাস পর এসে ওই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র, বিশেষ করে দেশের সংবিধান নিয়ে নতুন অবস্থান প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিজেদের সংগঠিত হবার প্রয়াস বলেই মনে করছেন তারা। ফলে এমন একটি অবস্থায় এই কর্মসূচির রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মনে প্রশ্ন আছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ দাবি উঠে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। এজন্য কেউ কেউ সংবিধানে পরিবর্তন আনারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে পুনর্লিখনের দাবি তোলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে।
মূলত সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে পরিণত হলেও, সেসময় সংবিধান পরিবর্তন বা বাতিলের বিষয়টি আলোচনা কিংবা দাবি – কোনো পর্যায়েই ছিল না।
কিন্তু এটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে ওই কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলম ‘এক দফা ঘোষণার দিনই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে’ – এমন মন্তব্য করার পরই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সংবিধান নিয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরোধিতা স্পষ্ট। আবার সরকারের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। সরকারের একজন উপদেষ্টা ৩১ ডিসেম্বরের ডাক দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। আবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে এটি প্রাইভেট উদ্যোগ। এসব কিছুই এ কর্মসূচিকে ঘিরে যে জল্পনা কল্পনা কিংবা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল তা প্রশমিত করে দিয়েছে।
তার মতে, যেহেতু নিজেদের সরকারই ক্ষমতায় সে কারণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ মিনারে গিয়ে দাবি উপস্থাপনের গুরুত্ব হয়তো সেভাবে থাকবে না। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল- সে জায়গা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা হয়ত সেটি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক মুজিবুর রহমান মনে করেন, ‘সংবিধানের প্রশ্নটি আন্দোলনের সময় আসেনি’ এবং এমন ‘নতুন অনেক কিছু মানুষ এখন শুনছে’ বলেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রতি যে আস্থা ও ম্যান্ডেট ছিল সেটা কিছুটা কমছে।
‘তাদের দাবি দাওয়া তো সরকারকে দেবে। সরকার তো তাদেরই। তাহলে শহীদ মিনারে ঘোষণা কেন?,’ প্রশ্ন এই বিশ্লেষকের।
‘এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বক্তব্যের পর তাদের বক্তব্যের মেরিট কমেছে। এখন ঘোষণাপত্রে কী থাকবে সেটা পরে জানা যাবে। কিন্তু এর মধ্যে তারা যা প্রকাশ করেছেন, সেগুলো মানুষকে খুব বেশি আকৃষ্ট করতে পেরেছে বলে হয় না,’ বলছিলেন তিনি।