নীলফামারীর সৈয়দপুরে লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ গভর্ণিং বডি ছাড়াই দীর্ঘদিন পরিচালনার পর অবশেষে প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষকে (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষা নগরী হিসেবে পরিচিত সৈয়দপুর শহরে সর্বমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীরা এতে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। লায়ন্স ক্লাবস্ ইন্টারন্যাশনাল জেলা ৩১৫ এ ২ বাংলাদেশ এর আওতায় লায়ন্স ক্লাব অব সৈয়দপুর সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীলফামারীর সৈয়দপুর লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যালয় শাখা এমপিওভূক্ত হলেও কলেজ শাখাটি ননএমপিওভূক্ত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশেষ কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত ২০২৩ সালের ২৬ জুন দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রতিষ্ঠানটির গভর্ণিং বডি অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই বছর মেয়াদী সাত সদস্যের গভর্ণিং বডির সভাপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যক্ষ লায়ন রেয়াজুল আলম রাজু এবং সদস্য সচিব হিসেবে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মো. শফিয়ার রহমান সরকার অনুমোদন প্রদান করা হয়।
এদিকে, সভাপতি পদে থাকা অবস্থায় রেয়াজুল আলম রাজু গত ৫ মার্চ আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। এতে করে প্রতিষ্ঠানটির গভর্ণিং বডির সভাপতির পদটি শূণ্য হয়ে পড়ে। এতে করে লায়ন্স ক্লাব অব সৈয়দপুরের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষিকারাও দুই ভাগে বিভক্ত পড়েন। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে আর এতে সভাপতি পদটিতে মনোনয়ন নিয়ে চরম কোন্দলের সৃষ্টি হয়। ফলে গত মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত কমিটির সভাপতি ছাড়াই পরিচালিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। এ অবস্থায় শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রতিষ্ঠানটির কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতনভাতাদি উত্তোলনের জন্য সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।
কলেজ সংশ্লিষ্ট সূেত্র জানা যায়, কলেজটিতে শফিয়ার রহমান সরকার গত ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে গত ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় বিশেষ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজে দেড় কোটি টাকার ওপরে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যহারের অভিযোগ উঠে। আর ওই দুর্নীতি ও সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে রংপুরের ধাপ,গঙ্গাচড়া রোডের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (লিঃ) এর চেয়ারম্যান ম. মাহবুব আলম খান মাউশি বরাবরে একটি অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল থেকে একটি তদন্ত করা হয়েছে। গত ২০২২ সালের ১৩ জুন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চল এর উপপরিচালক (কলেজ) মো. ওমর ফারুক সরেজমিনে এসে ওই তদন্ত করেন। মাউশির তদন্তে দুর্নীতে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) শফিয়ার রহমান সরকারের সম্পৃক্ত প্রমানিত হয়।
এ তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর) সহকারী পরিচালক তপন কুমার দাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির গভর্ণিং বডি ভেঙ্গে দেওয়াসহ তৎকালীণ অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মো. শফির্য়া রহমান সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সুপারিশ করে। ওই সুপারিশ করে মাউশি গত ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডকে একটি পত্র দেন। পরবর্তীতে গত বছরের ৩০ নভেম্বর দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক মো. আবু সায়েম কেন গভর্ণিং বডি ভেঙ্গে দেওয়া হবে না তার জবাব সাত দিনের মধ্যে চেয়ে একটি পত্র দেন কলেজ অধ্যক্ষকে। আর ওই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা মোতাবেক গত ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর শফিয়ার রহমান সরকারকে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আর গত ২৯ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র শিক্ষক মো. মসিউর রহমানকে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন।
এদিকে, সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানায় অফিসার ইনচার্জের (ওসি) কাছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দেওয়া অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শফিয়ার রহমান সরকারকে সভাপতি করার জন্য গত ৬ জুলাই কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মশিউর রহমানকে কলেজ গেটে থেকে অপহরণ করে সুপারিশপত্রে জোরপূর্বক স্বাক্ষর গ্রহন করা হয়। অপরদিকে, অজ্ঞাত কারণে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) শফিয়ার রহমান সরকারকে একই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি দিয়ে গত ২৮ আগস্ট সভাপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি তথা সাবেক অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মো. শফিয়ার রহমান সরকারের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর)তাঁর অফিস কক্ষে বসে কথা হয় এ প্রতিনিধি’র। তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন ও সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমি অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও দুর্নীতির সঙ্গে কখনোই জড়িত ছিলাম না। আর যে ব্যক্তিটি অভিযোগ করেছিলেন আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্ধান করেও তাঁর কোন হদিস পাইনি। আমার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে বলে জানান তিনি।
এ নিয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক কলেজ মো. আবু সায়েমের সঙ্গে মুুুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজটি একটি বিশেষ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়। ওই সংস্থার প্রধান কিংবা তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হতে পারেন। ওই সংস্থার প্রধান যাকে মনোনয়ন দিয়ে পাঠাবেন আমরা তাকে সম্মান করবো। এটি প্রবিধানমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এক সময় আপনার (কলেজ পরিদর্শক) স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির গভর্ণিং বডি ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য বলা হলো। পরবর্তীতে আপনার স্বাক্ষরিত পত্রে গত ২৮ আগস্ট শফিয়ার রহমান সরকারকে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি পদে অনুমোদন দেওয়া হলো এমন অপর একটি প্রশ্নের জবারে তিনি বলেন আমি ছুটি আছি। বিষয়টি অফিসে গিয়ে ফাইলপত্র দেখে বলতে পারবো।
এদিকে, নাম প্রকাশে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক’জন শিক্ষক কর্মচারী বলেন, শফিয়ার রহমান সরকার অধ্যক্ষ পদে থাকাকালিন আরও আর্থিক অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, যা তদন্ত করলেই প্রমাণ হবে। শহরের আরও অনেকে জানান, সুনামধন্য ওই প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বিশৃংখলা চলছে, সে সব তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ এটির সুনাম ক্ষুন্ন হওয়াসহ শিক্ষার মানও নিম্নমুখী হবে।