রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সাহাপুর দাখিল মাদ্্রাসায় সুপার আমিনুল ইসলাম। যার জালিয়াতির খবরে সরগরম পাঁচগাছি ইউনিয়নের গ্রাম, মহল্লা, অফিস পাড়া ও মাদ্্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। নিয়োগ প্রাপ্তির দু’বছর যেতে না যেতেই অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারনে টানা ১০ বছর সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। মুচলেকা দিয়ে ২০২৩ সালে স্বপদে ফিরে নিয়োগ বাণিজ্য, ভুয়া নিয়োগ, পদ পরিবর্তনসহ নানা জালিয়াতির সংশ্লিষ্টতার আবারও কল্প কাহিনীর নায়ক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়,পাঁচগাছি ইউপি’র পানেয়া গ্রামের মৃত নয়া মিয়া সরকারের ছেলে আমিনুল ইসলাম গাইবান্দা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলায় ত্রিমিলন দাখিল মাদ্্রাসায় সহ-সুপার পদে কর্মরত ছিলেন।
বিগত ২০১১ইং সালের ১ মার্চ পীরগঞ্জের সাহাপুর দাখিল মাদ্্রাসায় সুপার পদে যোগদান করেন। সেই সময়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন স্থানীয় জমি দাতা সদস্য নুরুল ইসলাম। যোগদানের পরেই নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠনে স্থানীয়দের সাথে বিরোধ শুরু হয়। বিধি বিধান উপেক্ষাসহ ইউএনও’র জাল স্বাক্ষরে তফশীল জালিয়াতির মাধ্যমে স্থানীয় শরিফুল ইসলামকে সভাপতি করেন। দাতা সদস্য নুরুল ইসলাম গঠনকৃত কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জে সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে অন্য ৬৭/১১ নম্বরে মামলা করে।
সুপার আমিনুল ইসলাম তার নিয়োগ বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সুপার শিক্ষক আমজাদ হোসেনের উপর সেই দায়ভার চাপিয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। বেতন-ভাতা প্রাপ্তিতে শিক্ষক আমজাদ হোসেন আদালতে অন্য ১২৬/১১ নম্বরে মামলা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০১২ সালের মে মাসে শিক্ষক আমজাদ হোসেনকে মৃত দেখিয়ে কাঠামো বহি:ভূতভাবে ইংরেজি ও সমাজ বিজ্ঞান পদে সাইফুল ইসলাম ও অমল চন্দ্র বর্মণকে নিয়োগ প্রদান করে।
১৭/০১/২০১৩ ইং আদালত শিক্ষক আমজাদ হোসেনকে বেতন-ভাতা প্রদানে সুপার ও কমিটির সভাপতিকে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন। কমিটি শিক্ষক আমজাদ হোসেনকে বেতন-ভাতা প্রদানে সুপারকে জানালেও সুপার গড়িমসি করতে থাকে। এ ঘটনায় ০২/০৩/২০১৩ইং কমিটি সুপারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০১৪ সালে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার দেখান সুপার তিনি। এ ঘটনায় সুপারের বিরুদ্ধে ভারপ্রাপ্ত সুপার একরামুল অন্য ৭৭/১৪ নম্বরে মামলা করে। শুনানিতে মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সুপারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও অমল চন্দ্র বর্মণ ২০১৫ সালে ব্যানবেইজে নাম প্রেরণসহ বেতন-ভাতা প্রদানে অন্য ১৩৮/১৫ নম্বরে মামলা করে। টানা ১০ বছর শিক্ষক একরামুল হক, ইদ্রিস আলী ও নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও অমল চন্দ্র বর্মণ বিনা বেতনে চাকুরি করে এক সময় নি:স্ব হয়ে অন্য পেশায় চলে যান। ক্ষমা প্রার্থনাসহ মুচলেকা দিলে সুপারকে ০২/০৫/২০২৩ তারিখে বিধি বহি:র্ভূতভাবে এডহক কমিটির সভাপতি আব্দুর ছাত্তার মিয়া ওরফে রাজা মিয়া স্বপদে বহাল করেন। স্বপদে ফিরে নিয়মিত কমিটি গঠনে আবারও কৌশলী হন।
প্রতিষ্ঠালগ্নের জমি দাতা সদস্য নুরুল ইসলাম, সচেতন অভিভাবক,মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতায় সহযোগিদের বাদ দিয়ে গোপনে ও কৌশলে প্রভাবশালী আ’লীগ নেতা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহিদুল ইসলাম পিন্টুকে সভাপতি করেন সুপার। এতে এলাকায় চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এলাকায় মানব বন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করো হয়। আ’লীগ নেতার দাপটের সুবাদে জালিয়াতিতে পারদর্শী সুপার রীতিমতো কেপরোয়া হয়ে উঠেন। প্রথমে চলতি বছরের শুরুতে সহ-সুপার ও নিরাপত্তা কর্মী পদে ২জনকে নিয়োগ দিয়ে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এতেও মন ভরে না সভাপতি ও সুপারের। আরও পদে নিয়োগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন ইউএনও আলাউদ্দিনের হাতে নিয়োগপ্রাপ্ত, এমপিওভুক্ত করনিক বা রুপান্তরিত পদ হিসেব সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর গোলজার হোসেনের পদ ২০২৪ সালের এপ্রিলে কাগজপত্রে শুন্য দেখিয়ে মাসিক উপস্থিতি প্রত্যয়নে ঘষা-মাজায় গোলজার হোসেনের নামের পাশে হিসাব সহকারির স্থলে ইবতেদায়ি মৌলভি পদ লিখে দেন।
এরপর আ’লীগ নেতার প্রভাবে অফিসিয়ালি হিসাব সহকারি পদটি শুন্য দেখানো হয়। এপ্রিলে গোপনে ও কৌশলে ল্যাবঃ এসিস্টেন্ট ও হিসাব সহকারি পদে ২ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। আবারও হাতানো হয় ২৫ লক্ষাধিক টাকা। এরপর গোপনে নিয়োগ, যোগদান, অত:পর ব্যানবেইজ প্রেরণ করেন। জুনে এমপিওভুক্তির পর প্রতিষ্ঠানে আসেন নিয়োগপ্রাপ্ত ল্যাবঃ এসিস্টেন্ট রবিউল ইসলাম, হিসাব সহকারি মাসুদ রানা ও শিক্ষক মমিনুল ইসলাম। ২০২৪ সালে মমিনুল ইসলাম নামের শিক্ষকের এমপিওভুক্তিতে শিক্ষক-কর্মচারী ও এলাকাবাসী বিস্মিত হন। ২০১৩ সালে নিয়োগ, যোগদান দেখিয়ে ২০২৪ সালে মমিনুলকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গে তৎকালিন সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও শিক্ষক প্রতিনিধি তাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালে নিয়োগ বোর্ডে মমিনুল ইসলাম নামে কেউ আবেদন করেনি। সাইফুল ইসলাম ও অমল চন্দ্র বর্মণকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এক যুগেও তারা এমপিওভুক্ত হয়নি। হঠাৎ মমিনুল ইসলাম ২০১৩ সালের নিয়োগে এমপিওভুক্ত কিভাবে ? এ প্রসঙ্গে মমিনুল ইসলাম জানান, অমল চন্দ্র বর্মণের পরিবর্তে তাকে নিয়োগ দিয়েছে সুপার। এতদিন পরে এমপিওভুক্ত কিভাবে ? জবাবে জানান, প্রায় ১০ লাখ টাকা সুপারকে দিয়ে চাকুরি নিয়েছি, উনি (সুপার) সবকিছু জানেন।
গোলজার হোসেন জানান, ১৯৯৮ থেকে প্রায় ২৭ বছর, অফিস সহকারি পদে বেতন নেই। জুলাই মাসে হাজিরায় নামের পার্শে¦ পদবি ইবতেদায়ি মৌলভি দেখে সন্দেহ হয়। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানে নুতন ২জনের আগমন ঘটে। অফিস সহকারি দাবি করে মাসুদ রানা চেয়ার-টেবিল দখলে নেয়। এমপিও কপিতেও অফিস সহকারি পদে মাসুদ রানার নাম এবং আমার নামের পাশের্^ কোন পদ উল্লেখ না থাকায় দুঃশ্চিন্তায় পড়ি। ৮ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ১৫ জুলাই জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অভিযোগ করি। ৩০ জুলাই মাদ্্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজি’র নিকটও আবেদন করি।
উপ-পরিচালক (প্রশাসন) তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে ২৭ আগষ্ট মৌখিকভাবে শুনানিতে সুপারকে তলব করলে সুপার অনুপস্থিত থাকেন। ৪ সেপ্টেম্বর শুনানিতে উপস্থিতিতে সুপারকে চিঠি প্রেরণ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সেখানে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১২ অক্টোবর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ডিজি’র বরাবরে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ইবতেদায়ি মৌলভি পদে বেতন গ্রহনে অস্বীকৃতিতে জুন মাসের বেতন স্থগিত করেন সভাপতি ও সুপার। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুলাই থেকে অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠানের বেতন ভাতা প্রদান বন্ধ রেখেছেন।
এদিকে অক্টোবর মাসে এমপিও কপিতে আমি, সহ সুপার আমিনুল ইসলাম ও দাবীকৃত অফিস সহকারি মাসুদ রানার বেতন সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। জমি দাতা নুরুল ইসলাম, গ্রামবাসী, শিক্ষক একরামুল, ইদ্রিস আলী,নজরুল ইসলাম জানান,এলাকার লোকজন প্রচন্ড ক্ষিপ্ত, সুপার ৫/৬ মাস ধরে প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত, কৌশলে হাজিরা খাতায় ২/৩ মাসের হাজিরা এক সাথে স্বাক্ষরের ঘটনাও ঘটে। ৩ মাস ধরে স্বাক্ষর দিতে পারছে না তিনি। জালিয়াতিতে এক্সপার্ট সুপার, এমপিও ভুক্তির পর নিয়োগের কথা জানাজানি হয়। নিয়োগে ৬০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সুপার ও সভাপতি।
এদিকে মাদ্রাসায় শিক্ষক ও ছাত্রীদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাথরুম নেই, বৃষ্টি হলে প্রতিটি ক্লাসরুমে পানি পড়ে, ছাত্র-ছাত্রীদের ব্রেঞ্চসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই। এক যুগের বেশি বেতন-ভাতা ছাড়া ২জন শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করলেও হঠাৎ মমিনুল নামের একজন নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াই শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়েছে। এনটিআরসি’র শিক্ষক মৌসুমী আকতার, কাকলি রানী ও ছিদরাতুন মোন্তাহার জানান, নিয়োগের পর আমাদের যোগদান নিয়ে নানা টালবাহানা করায় সুপারকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে যোগদান করেছি। সিনিয়র সহকারি মৌলভি শিক্ষক একরামুল হক জানান, এমপিও কপিতে অফিস পিয়ন আমিনুলকে পরিছন্ন কর্মী, বিজ্ঞানের শিক্ষক রতন চন্দ্রকে সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক, হিসাব সহকারিকে ইবতেদায়ি মৌলভি এরকম পদ পরিবর্তনের খেলা খেলেন সুপার, ২০১৩ সালের নিয়োগ ২০২৪ সালে এমপিও ভুক্ত, শিক্ষক মমিনুলের ভুয়া নিয়োগের বিষয়টি বিআরডিসি উপ-সহকারি প্রকৌশলী আবু সায়েম সাদত তদন্ত করছেন।
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন মন্ডল জানান, ১২ অক্টোবর প্রেরিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সুপার আমিনুল ইসলাম ও হিসাব সহকারী মাসুদ রানার এমপিও ইনডে´ স্থায়ীভাবে কেন কর্তণ করা হবে না, মর্মে ৭ নভেম্বর লিখিত জবাব ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ শুনানিতে অংশ নিতে নির্দেশ দিয়েছে মাদ্্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের এমপিও বাছাই ও অনুমোদন কমিটির সদস্য সচিব সহকারী পরিচালক (অর্থ) শরিফুল ইসলাম।
ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি শাহিদুল ইসলাম পিন্টু নিয়োগ বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করে বলেন,ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিরা প্রতিস্বাক্ষর করে থাকেন, তারা নিয়োগ দেন না, সরকারি লোক মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ডিজির প্রতিনিধিরা নিয়োগ দিয়ে থাকেন, প্রতিষ্ঠান প্রধান সবকিছু প্রসেস করেন। এ প্রসঙ্গে সুপার আমিনুল ইসলামের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি।