রংপুরের বদরগঞ্জে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নামে ব্যবসায়িক বিরোধকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তাক্ত সংঘর্ষ। প্রাণ হারিয়েছেন বিএনপির নিবেদিত কর্মী লাভলু মিয়া সরকার (৪০)। দোকানঘর ভাড়া নিয়ে পুরনো বিরোধ দলীয় কোন্দলে রূপ নেয়। আর সেই দ্বন্দ্বের বলি হন এই কর্মী। এ ঘটনায় উত্তেজনা ও গভীর ক্ষোভ বিরাজ করছে উপজেলায়। খুনের ঘটনার মূল হোতারা প্রকাশ্যে ঘুরলেও কোনো মামলা হয়নি। হয়নি কোনো গ্রেপ্তার। দলের মধ্যে দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা, প্রশ্নবিদ্ধ জেলা বিএনপির ভূমিকা নিয়ে।
ঘটনার সূত্রপাত শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-সংলগ্ন একটি দোকানঘরকে ঘিরে।
দীর্ঘদিন ধরে দোকান মালিক ইশতিয়াক বাবু ও ভাড়াটিয়া ঢেউটিন ব্যবসায়ী জাহিদুল হক জোয়ারদারের মধ্যে দোকানঘর ভাড়ার মেয়াদ সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। চুক্তি ২০২৮ সাল পর্যন্ত থাকলেও মালিক ইশতিয়াক আগে দোকান ছাড়তে বলেন। জাহিদুল অস্বীকৃতি জানান। এরপরই ইশতিয়াক আশ্রয় নেন সাবেক এমপি ও উপজেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ আলী সরকারের কাছে। অন্যদিকে জাহিদুল আশ্রয় নেন ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিকের কাছে। যিনি নিজেকে বিএনপির নেতা দাবি করলেও জেলা ও উপজেলা কমিটিতে বর্থমানে তার কোনো পদ নেই।
এদিকে ঘটনার ঠিক আগের দিন, শহিদুল হক মানিকের ছেলে তানভির আহমেদ তমাল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকারকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ, ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক স্ট্যাটাস দেন। এই স্ট্যাটাসের পর বদরগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তাল হয়ে ওঠে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, তারপর ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গত শনিবার সকালে। শহীদুল হক মানিকপন্থীরা দোকানঘর খুলে দেওয়ার দাবিতে শহীদ মিনারে মানববন্ধনের ডাক দেন। এর প্রতিবাদে মোহাম্মদ আলী সরকারের অনুসারীরা লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রসহ শহরে মিছিল বের করেন। তারা মানববন্ধনের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন এবং শহীদ মিনারে স্থাপিত সামিয়ানা নামিয়ে দেন।
এর মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটের ব্যবধানে পাল্টা হামলা চালায় মানিকপন্থী সশস্ত্র দল। তারা পৌরশহরের বাচ্চা মিয়ার গলির আলম মার্কেট এলাকায় উভয়পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন সাতজন, যাদের মধ্যে লাভলু ছিলেন সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায়। তাকে রংপুর মেডিক্যালে নেওয়া হলে বিকেল সাড়ে ৫টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রোববার সকালেই রংপুর মেডিক্যালে লাভলুর ময়নাতদন্ত স¤পন্ন হয়। পরে মরদেহ বদরগঞ্জে এনে শহীদ মিনারে রাখা হয় অ্যাম্বুলেন্সে। সেখানে আয়োজিত প্রতিবাদসভায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শতশত নেতাকর্মী অংশ নেন। বক্তারা শহিদুল হক মানিক ও তার ছেলে তমালকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তির দাবি জানান।
এসময় বক্তারা অভিযোগ করেন, শহিদুল হক মানিক অতীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এখন বিএনপিকে ব্যবহার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। তার দলীয় পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। নেতারা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, অনুগ্রহ করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, মানিককে বিএনপি পরিচয়ে তুলে ধরবেন না। সে বহিরাগত সন্ত্রাসী।
এদিকে বাদ আসর নিহত লাভলুর জানাজা হয় মধুপুর ইউনিয়নের রাজারামপুর কালজানি গ্রামে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির শত শত নেতাকর্মী ও স্থানীয় সাধারণ মানুষ। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন স¤পন্ন হয়।
দলীয় দ্বন্দ্ব ও কারণ দর্শানো নোটিশে দেওয়ার ঘটনায় বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে চরম
বিতর্ক। জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন, সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার, হুমায়ুন কবির মানিক ও ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক। মানিক বিএনপির কেউ নন। অথচ তাকে নোটিশ করায় ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে স্থানীয় বিএনপির নেতাদের পক্ষ থেকে। উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির মানিক ও এনামুল হক বলেন, ‘শহিদুল হক মানিক বিএনপির কেউ না। বরং সে জামায়াত-শিবিরের লোক। তার বিরুদ্ধে নোটিশ নয়, গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা উচিত ছিল।
সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, লাভলু আমার সন্তানের মতো ছিল। ছোটবেলা থেকে ওকে দেখেছি। দেখাশোনা করেছি। তার এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, শহিদুল হক মানিকের ছেলে তমাল আমার বিরুদ্ধে অশ্লীল স্ট্যাটাস দিয়েছে। অথচ তমালই বদরগঞ্জে বহু দখল, হামলার ঘটনায় জড়িত। ওকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে থানা পুলিশকে অনুরোধ করেছি। তারা কোন কথা শুনেনি। পুলিশের রহস্যজনক ভুমিকা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও রবিবার থেকে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিকের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে তার পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক পরিতোষ চক্রবর্তী স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, ‘শহিদুল হক মানিক দলের কেউ নন। উপজেলা কমিটির বা অঙ্গ সংগঠনের কোন পদেও নেই সে। কিন্তু তাকে সদস্য বানিয়ে জেলা বিএনপি থেকে কেন কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হলো। এ জন্য আমি জেলা বিএনপির কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
বদরগঞ্জের ঘটনাটি শুধু একটি খুন নয়, বরং এটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি, নেতৃত্ব সংকট। এবং বহিরাগত দখলবাজদের ক্ষমতার লড়াইয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ। এই সহিংসতা শুধু একজন কর্মীর প্রাণ নেয়নি। বরং বিএনপির ভেতরে তীব্র বিভাজনের বার্তা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাধারণ মানুষ। বদরগঞ্জ থানার ওসি এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে। আর কোন বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। তবে এখনও কোনো মামলা হয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে রোববার সন্ধ্যায় বিএনপি কর্মী লাভলু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে বদরগঞ্জ পৌরশহরে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে। উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ন আহ্বায়ক হুমায়ূন কবির মানিকের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক তার ছেলে তমাল ও একই অপরাধে জড়িত থাকায় বদরগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি সারোয়ার জাহান মানিককে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। মিছিল থেকে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করার দাবি করা হয়। মিছিল নিয়ে বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা পৌরশহর প্রদক্ষিণ করে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকারের বাসভবনে যান।