গণহত্যার অভিযোগে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি আবারও জোরালো হয়েছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে টানা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন ছাত্র-জনতা। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করেছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু দল একাত্মতা ঘোষণা করেছে। অনেকে অবরোধে যোগ দিয়েছেন। এই অবস্থায় বড় দল হিসেবে বিএনপির অনুপস্থিতির বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। যারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তারাও চাচ্ছেন তাদের দাবির সঙ্গে বিএনপি একাত্মতা ঘোষণা করুক।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি উঠছিল বিভিন্ন মহল থেকে। তবে বিএনপিসহ কোনো কোনো দল এবং সরকারের মনোভাব ছিল আইন করে নিষিদ্ধ না করা। এর মধ্যেই গতকাল খবর আসে সাবেক রাষ্ট্রপতি হত্যা মামলার আসামি আব্দুল হামিদ গভীর রাতে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর ছাত্র-জনতা নতুন করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে রাজপথে নামেন। বৃহস্পতিবার রাতে তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন এবং রাতভর আন্দোলন চালিয়ে যান। বিকেলে সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সেই সমাবেশে এই আন্দোলনের অন্যতম নায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা শাহবাগ ছাড়বেন না। এরপর সমাবেশ থেকে হাজার হাজার জনতা মিছিল সহকারে শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান নেন। রাত পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করছেন।
শাহবাগে আন্দোলনরতরা দাবি করছেন, বিএনপিও তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করুক। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম সন্ধ্যায় ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘বিএনপি আসলে জুলাইয়ের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়। আজকের এই শাহবাগ ইতিহাসের অংশ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির মানদণ্ড।’
এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন- ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি শুধু এনসিপির দাবি নয়। এই দাবি জুলাইয়ের সকল শক্তির দাবি। এই সমাবেশ জুলাইয়ের সকল শক্তির সমাবেশ।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশা করছেন। বিএনপি কেন এই ইস্যুতে নীরব সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। বিএনপি এ ব্যাপারে কী অবস্থান নেবে, তাদের বক্তব্য কী সে সম্পর্কে জনমনে কৌতূহল দেখা দিয়েছে।
বিএনপি এর আগে আওয়ামী লীগ প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও গতকাল থেকে দলীয়ভাবে তাদের কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দলটির নেতারা তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। তারা সেই পুরনো বক্তব্যেই অটল রয়েছেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দায়িত্ব তার জনগণের ওপর দিতে চান। জনগণ যদিও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
এর মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না; সেটা তো বিএনপির বক্তব্যের বিষয় নয়। এটা নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেসব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বলছে তারা তাদের বক্তব্যে বলেছে। কাজেই বিএনপি হিসেবে তো আমরা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক নই। আমাদের মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) ইতোমধ্যে বলেছেন যে, জনগণের সিদ্ধান্তের বিষয় এটা। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কারা নির্বাচন করবে কি না করবে।
নিজের যুক্তি তুলে ধরেন তিনি বলেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে কি আসবে না বা তাদের গ্রহণ করা হবে কি হবে না বা তাদের নিষিদ্ধ করা হবে কি হবে না। আমি যদি বলি এই প্রশ্নটা আওয়ামী লীগকে কেন জিজ্ঞাসা করেন না। তারা কি আসলেই নির্বাচন করতে চায়, তারা কি আসলেই গণতন্ত্র চায়? সেটা তো আওয়ামী লীগকে বলতে হবে।
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগকে মানুষ দেখতে পারছে না। কারণ, তারা তাদের অপকর্মের ফল পাচ্ছে। এই আওয়ামী লীগের জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। তাই বিগত আমলে কোনো ভোট হয়নি। আওয়ামী লীগ যে কাজ করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই তাদের করতে হবে।’
এদিতে জোরদার আন্দোলনের মুখে এক বিবৃতিতে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। এ ব্যাপারে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইতোমধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, তাদের সাথে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে। সে পর্যন্ত সকলকে ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানাচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি ফেসবুকে লেখেন- আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের সুযোগ রাখার লক্ষ্যে আইসিটি আইনে সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় ছিল। আইন উপদেষ্টা হিসেবে আমি নিজে এটা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উত্থাপন করেছি। আমার উত্থাপিত খসড়ার আমিই বিরোধিতা করব এটা কীভাবে সম্ভব? উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কোনো উপদেষ্টা কী ভূমিকা রেখেছেন এনিয়ে আমাকে, ছাত্র উপদেষ্টাদের বা অন্য কাউকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকুন। সেখানে যা সিদ্ধান্ত হয় তার দায় দায়িত্ব আমাদের প্রতিটি উপদেষ্টার।
আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই। তবে পদ্ধতি নিয়ে সবার নিজস্ব মত থাকতেই পারে।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, আইসিটি আইন চাইলেই আমরা কয়েক দিনের মধ্যে সংশোধন করতে পারবো। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য সন্ত্রাস দমন আইনসহ অন্য আইনগুলোও আছে। কাজেই আইন কোনো সমস্যা না। রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ চাইলে বা বিচারিক আদালত এ সম্পর্কে কোনো পর্যবেক্ষণ বা রায় আসলে অবশ্যই আইনানুগভাবে দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাবে। আমরা সেই প্রত্যাশায় আছি। ইনশাল্লাহ্।