তহমিনা বেওয়ার বয়স এখন আটচল্লিশ বছর। বিয়ে হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে। এক ছেলে সন্তানের জননী তিনি। ১২ বছর আগে স্বামী মারা যান। তহমিনা বেওয়ার বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের বারোমাসিয়া নদীর তীরে কৃষ্ণানন্দ গ্রামে। স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রথম এক দুই বছর তহমিনার সংসার চালাতে খুবই হিমশিম খেতে হতো। প্রায় সময় সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। অভাব যেন তার নিত্যসঙ্গী।
একমাত্র ছেলে সন্তান নিয়ে চরম দুচিন্তায় ছিলেন তিনি। অভাবের সংসারে তার একমাত্র ছেলে তাজুল ইসলাম (১৮) নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেই সমপ্তি ঘটে। সেই সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট স্বীকার করে নেয় । এরপর তিনি জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন। মনোযোগ দেন কৃষি কাজে। স্বামীর রেখে যাওয়া বারোমাসিয়া নদীর চরাঞ্চলে এক একর জমিতে মরিচ, আলু ও ধানের চাষাবাদ শুরু করেন এবং সন্তানকে নিয়ে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পুরুষ চাষিদের সাথে পাল্লা দিয়ে একজন নারী হয়ে তিনি গত ৮ বছর ধরে মরিচ, ভুট্টা, আলু ও ধানের চাষাবাদ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তহমিনা। জীবন-যুদ্ধে তিনি একজন সংগ্রামী নারী। এ বছর আবহাওয়া অনুকুল থাকায় তহমিনা বেওয়া রোপণকৃত ফসল মরিচ ও আলুর ফলন ভালোই দেখা যাচ্ছে। তহমিনা বেওয়ার ওই সব ফসলের খেত দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। বারোমাসি নদীর চরাঞ্চলে আবহাওয়া অনুকুল থাকায় ভালো ফলন আসবে বলে চাষিরা আশা করছেন তিনি।
তহমিনা বেওয়া জানান, আমার স্বামী ১২ বছর আগে মারা। আমার এক সন্তান। স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে পড়ে। কারো কোন সহযোগিতা পাইনি। স্বামীর রেখে যাওয়া জমিগুলো বারোমাসি নদীর তীরে। কোন রকমেই দুইটি ফলন উৎপাদন করা যায়। বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম করেই এক ছেলেসহ কিছু জমাতে না পারলেও স্বচ্ছলভাবে জীবন চালাচ্ছি।
তহমিনা আরও বলেন, সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন এভাবেই আজীবন কৃষি কাজ করে এক সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। তিনি ক্ষোভ জানান, টানা ৮ বছর ধরে মরিচ আলুুসহ বিভিন্ন ফসল রোপণ করে আসলেও কোন দিন কৃষি অফিসের পরামর্শ ও কোন ধরণের সহযোগিতা পাননি। সামান্য একটা স্প্রে মেশিন এর জন্য ৮ বছর ধরে চেয়ারম্যান-মেম্বারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সেই স্প্রে মেশিনটি তার ভাগ্যে জোটেনি। তিনি সকালে খাওয়া খেয়ে জমিতে আসেন এবং বাড়ীতে যান ঠিক সন্ধ্যায়। এক দুইজন কৃষি শ্রমিক নিয়ে এক একর জমির ফলনের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন তহমিনা বেওয়া। তিনি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি কাজের সব ধরণের সহযোগিতার জন্য সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন।
প্রতিবেশী কবিদুল ইসলাম জানান, তহমিনা বেওয়া খুবই একজন পরিশ্রমী নারী। প্রায় আড়াই তিন বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলান। মাঝে মধ্যে এক দুইজন শ্রমিক নেন। বাকি সময় তিনি নিজে সব কাজ করে। তবে ছেলেটা তার মায়ের কাজে খুব বেশি সহযোগিতা করে না। তারপরও তিনি কৃষি কাজের উপর এক ছেলে নিয়ে অনেকটা স্বচ্ছলভাবে সংসার চালিয়ে আসছেন। এমনকি তিনি বাড়ী বীজ দিয়ে এ সব ফসল উৎপাদন করেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি হাস, মুরগী ও ছাগল লালন পালন করেন তহমিনা। এভাবেই মাঠে ময়দানে লড়াই সংগ্রাম করেই যাচ্ছেন তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা : নিলুফা ইয়াছমিন জানান, তহমিনা বেওয়ার মতো নারীরা কৃষি কাজে এগিয়ে আসলে কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই সাথে কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে নারীদের যেমন কৃষির উপর আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে বাড়বে কৃষি উৎপাদনশীলতাও। কৃষি বিভাগ থেকে তহমিনাকে প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।