আমি গাইবান্ধার সন্তান। নয় ভাই বোনের মাঝে পাঁচ নম্বর আমি। এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আর পড়াশুনা হয়নি। ১৯৯০ সালে বাবা মারা যান। এরপর থেকেই সংসারের সব দায়িত্ব কাঁধে আসে আমার। বাবাও ছিলেন কৃষক।
ওনার সাথেই কৃষি কাজ শিখেছি। পরিবারের সাথে ১৯৯৩ সালে অভিমান করে পাশের উপজেলা পলাশবাড়ীর ঢোলভাংগা নামক স্থানে কাপড়ের দোকানে চাকুরি নেই। সেখানে দীর্ঘ সাত বছর চাকুরি করি। এরপর সব ভুলে বাড়িতে ফিরে আসি। মুদি দোকান দেই। একবছর পরেই বিয়ে সাদি করি। বিবাহিত জীবনের দশ বছর পরেই অনেক চিন্তার পরে লেবু চাষের চেষ্টা করি। শুরু হয় বিভিন্ন নার্চারীসহ বাগানে গিয়ে পরামর্শ নেয়া। কথা গুলো বলছিলেন গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা আবদুর রশিদ (৫১)। ধানের বদলে লেবু চাষের তৃতীয় বছর থেকেই বাজিমাত করেছেন তিনি।
পৈত্রিক মাত্র ২০ শতক জমিতে লেবুর বাগান করেন। বিগত ও চলতি বছরেও প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় করেন। পাশাপাশি তিনি সাথী ফসল হিসেবে বেগুন, লাউ ও করলাসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষ করেছেন। একটির পর একটি ফসল থেকে তিনি লাভবান হন। কৃষক আব্দুর রশিদ পৈত্রিক সুত্রে ওই লেবুর বাগানের জমিসহ মোট ৪০ শতক জমি পান। এর মধ্যে সবজি ও লেবু চাষ অর্ধেক জমিতে। বাকি অর্ধেক জমিতে ধানের চাষ করেন।
২০ শতকে ধান উৎপাদন খরচ পড়ে ৮ হাজার টাকা। ধান উৎপন্ন হয় ১৪ মন। মণ প্রতি ৮০০ টাকা হিসেবে ধানের মূল্য দাঁড়ায় মোট ১১ হাজার ২০০ টাকা। উৎপাদন খরচ বাদে আয় হতো তিন হাজার ২০০ টাকা। অথচ একই পরিমাণ জমিতে লেবুর গাছ লাগিয়ে আব্দুর রশিদ ৭৩ হাজার টাকা আয় করেন। আরও কয়েক হাজার টাকার লেবু গাছে রয়েছে। প্রায় ৯ বছর আগের বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে সবুজ রঙের লেবু। প্রতিনিয়তই জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগ্রহীরা বাগান দেখে লেবু চাষে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। তারা তৈরি করেছেন বাগান।
সরেজমিনে আব্দুল রশিদ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে কথা হয়। তিনি লেবুর বাগান ও মৎস্য খামার ঘুরে দেখান। স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, লেবু চাষের আগে একটি মুদির দোকান দেই। সেখানে মূলধন একাধিকবার হারিয়ে ফেলি। এরপর আবার কৃষি কাজ শুরু করি। কয়েক বছর ধান চাষে তেমন আয় করতে পারিনি। নিজ উদ্যোগে ২০ শতক জমিতে দেশি জাতের লেবু গাছের চাড়া রোপন করি। পাশাপাশি মৎস্য খামার ও হাঁসমুরগি পালনও করতে থাকি। নিজ বাড়িতে তিনি কৃষি খামার তৈরি করেন। বর্তমানে এখান থেকে যে আয় হয়, তা দিয়েই সংসার ও তিন ছেলে সন্তানের সব খরচ চলে।
উদ্যোক্তা কৃষক আব্দুর রশিদ আরও বলেন, লেবু বাগান ও বাড়ির কৃষি খামারে মনোবিশন করি নিজেকে। জৈষ্ঠ্য মাস থেকে কার্তিক মাসের শেষ পযর্ন্ত লেবু পাওয়া যায়। ৭৩ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করেছি। আরও ৩০-৩৫ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করতে পারবো। অর্থাৎ ২০ শতকের লেবু উৎপাদন হয় প্রায় লক্ষাধিক টাকার। ২০ শতকে উৎপাদন ও হাটের খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ বাদে পাঁচ মাসে আয় হয় ৮৫-৯০ হাজার টাকা। অথচ একই জমিতে বোরো ধান চাষে চারমাসে আয় হয় তিন হাজার ২০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, ধানের চেয়ে লেবু চাষে লাভ বেশি।
সাদুল্যাপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসরাণ বিভাগের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু হাসান বলেন, লেবু চাষ ছাড়াও অন্য ফসল করতে কৃষক আব্দুল রশিদকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তিনি লেবু চাষ করে লাভবান।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে তাঁর লেবু বাগানের পাশেই পারিবারিক পুষ্টি বাগান করা হয়েছে। আব্দুর রশিদকে নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তার সাফল্য দেখে ওই গ্রামের অনেক কৃষক লেবু চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা।