বাংলাদেশ

ভারতীয় সেই চিতা বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী

আবু সালেহ মোঃ রায়হান   পঞ্চগড়

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪


| ছবি: 

পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার তোড়িয়া ইউনিয়নের দ্বারখোর সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ভারতীয় চিতা বাঘটিকে গতকাল শুক্রবার (২ জানুয়ারী) সকালে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ধাওয়া করে মাছ ধরার জাল দিয়ে ধরে ফেলেন। পরে বাঘটিকে বাশেঁর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। তবে স্থানীয় এক কৃষকের গরু খেয়ে ফেলা ও গরুতে বিষ প্রয়োগের বিষয়টিও ঢাকা থেকে আসা তদন্তকারী দলকে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। যদিও এ তথ্যটি তদন্তকারী দলের কাছে ভিত্তিহীন বলে মনে হয়েছে মর্মে জানা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট কাউকে কোন আইনী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা থানায় হয়নি কোন সাধারণ ডায়েরীও।
এদিকে শুক্রবার রাতে বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ফেসবুকে প্রচার করেন আজিজার রহমান নামে স্থানীয় এক যুবক। পরে ভিডিওটি দ্রুতই ভাইরাল হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়।
ভিডিওটিতে আরো দেখা যায়, চিতা বাঘটি স্থানীয় এক কৃষকের গরু খেয়ে ফেলে এমন অভিযোগে আটোয়ারী উপজেলার তোড়িয়া ইউনিয়নের দ্বারখোর সীমান্ত এলাকার স্থানীয় মানুষজন শুক্রবার সকালে চিতা বাঘটিকে লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া করেন। আর বাঘটি ভয়ে নদীর পানিতেই ছোটাছুটি করছে। পরে বাঘটি প্রাণে বাঁচতে ওই এলাকার পুরাতন ইদগাহ সংলগ্ন সীমান্তঘেষা নাগর নদীতে নেমে পড়ে। পরে শত শত স্থানীয় মানুষজন নদীতে নেমে মাছ ধরার জাল দিয়ে বাঘটিকে তাড়া করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বাঘটি জীবন বাঁচাতে নদীর তীরে একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। তবে সেখানেও স্থানীয়রা ধাওয়া দিলে আবারো নদীতে নামে বাঘটি। এক পর্যায়ে বাঘটি ক্লান্ত হয়ে স্থানীয়দের জালে ধরাশায়ী হয়। পরে বাঘটিকে ধরে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এদিকে হত্যার পরে বাঘটিকে একটি বাঁশে বেধে নেয়া হয় বোধঁগাঁও বিজিবি ক্যাম্পে। পরে সেখান থেকে বাঘটিকে নেয়া হয় বারঘাটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে। সেখান থেকে বাঘটিকে ময়নাতদন্তের জন্য আটোয়ারী উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে নেয়া হয়। পরে শুক্রবার বিকেলে বাঘটির ময়নাতদন্ত করেন উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
তবে স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি, বন বিভাগের লোকজন সহ সংশ্লিষ্টরা দাবী করেন, বাঘটি গত নয়দিন আগে স্থানীয় এক কৃষকের একটি গরু খেয়ে ফেলে। পরে গরুটিতে বিষ ছিটিয়ে রাখা হয়। সেই গরুটি খেয়ে নদীতে পানি খেতে নামে চিতা বাঘটি। একপর্যায়ে সেখানেই মরে পড়ে থাকতে দেখেন নাগর নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া কয়েকজন। পরে বাঘটিতে উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় গৃহবধূ ময়না বেগম বলেন, গত রবিবার আমার একটি গরু মারা যায়। গরুটিকে বাঘ নাকী শিয়াল আক্রমন করেছিল জানি না। তবে আমার ছোট ছেলে বলেছিল, ‘মা আমাদের এতবড় ক্ষতি হলো, আমি তাকেও মেরে ফেলবো। এরপর সে গরুর মধ্যে অল্প করে দানাদার বিষ দিয়েছে বলে শুনেছি। এখন বাঘটি বিষ খেয়ে মারা গেছে, নাকি ঠান্ডায় অসুস্থ্য বা অন্য কোন কারণে মারা গেছে আমি জানি না।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল জব্বার বলেন, বাঘ দেখতে পাওয়ায় চেচামেচি শুনে আমি কাছে যাই। দেখি বাঘটি বসে আছে এবং আমরা কাছে গেলেও বাঘটি ঠিকমত নড়াচরা করতে পারছিল না। আমরা তখন একটি জাল দিয়ে বাঘটিকে ঢেকে দেই। তখন বাঘটি নড়াচরা শুরু করলে একটি লাঠি দিয়ে ভালো করে জালে প্যাচিয়ে ধরি। তখন বাঘটি মনে হয় মারা গিয়ে নদীতে ডুবে যাচ্ছিল। পরে নদী থেকে ডাঙায় নিয়ে একটি বাশঁ দিয়ে বাঘের চার পা বেধে সামনে নিয়ে আসি।
এদিকে বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্য প্রানী অপরাধ দমন ইউনিটের বন পরিদর্শক অসিম মল্লিকের নেতৃত্বে তিন সদস্যর প্রতিনিধি দল এসেছেন ঘটনাটি তদন্তে। তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে একটি মৃত বাঘ উদ্ধারের বিষয়টি জানার পরে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে শনিবার দিনব্যাপী তদন্ত কাজ পরিচালনা করা হয়। এসময় স্থানীয় মানুষজন, জনপ্রতিনিধি সহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের সাথে কথা বলেছি আমরা। তবে প্রাথমিক তদন্তে বাঘটিকে শ্বাসরোধে হত্যার বিষয়টি পেয়েছি আমরা। বাঘটিতে হত্যায় স্থানীয়রা জড়িত ছিল। আমরা বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাঘের শরীর এবং উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত জাল থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি। এখন বিষ টোপের কারণে নাকি মানুষের আঘাতে বাঘের মৃত্যু হয়েছে এটা আরও পরে নিশ্চিত করে বলা যাবে। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে আসলে বোঝা যাবে কিভাবে মৃত্যু হয়েছে। তবে আমাদের তদন্তে উঠে আসা  বিষয়গুলো নিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করবো।
এদিকে, তোড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আমার বাড়ি সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে। আমি স্থানীয়দের কাছে শুনতে পাই যে একটি বাঘ গরুকে খেয়েছে। পরে গরুতে বিষ দেয়া হলে বাঘটি গরুটি খেয়ে মারা যায়। তবে বাঘটিতে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি আমি জানতাম না। আজকে একটি তদন্তকারী দল ঢাকা থেকে এসেছিল। তবে তারা আমার সাথে কথা বলেনি।
পঞ্চগড় সামাজিক বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মধুসুধন বর্মন বলেন, চিতাবাঘটি হত্যার ঘটনায় দোষীদের সনাক্তে কাজ করছি আমরা। তবে বাঘটিকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে এমন কিছু তথ্য পেয়েছি আমরা। ঢাকা থেকে বন বিভাগের লোকজন এসেছে তারাও তদন্ত করছে। স্থানীয়ভাবেও তিন সদস্যর একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যারা দোষী সনাক্ত হবেন বন্য প্রানী আইন অনুযায়ী অবশ্যই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
আটোয়ারী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা ও বিষ প্রয়োগে হত্যার কোন আলামত পাওয়া যায় নি।  তারপরও পরবর্তীতে ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য আলামত  রেফার্ড করা হয়েছে ল্যাবে। এখানে পিটিয়ে হত্যা, বিষ প্রয়োগে সহ তিন ধরনের কথা এসেছে। তবে পোস্ট মর্টেমের সাথে তেমন মিল পাওয়া যায়নি। হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভিসেরা পরীক্ষার প্রয়োজন।  এজন্য ঢাকায় ল্যাবে স্যাম্পল পাঠানো  হয়েছে। রির্পোট কত দিনের মধ্যে আসবে তা বলা যাচ্ছেনা। রিপোর্ট পেলেই মৃত্যুর বিষয়টি জানা যাবে।
আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেদুল হাসান বলেন, আমরা উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্তকাজ চলমান রয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পেলেই জানা যাবে প্রকৃত ঘটনা।
এদিকে, শুক্রবার সকালে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ভারতীয় দাড়খোর সীমান্ত এলাকায় নাগর নদীর পাড় থেকে চিতা বাঘটির মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগের লোকজন। পরে আটোয়ারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে প্রাথমিক ময়নাতদন্ত শেষে বাঘটির মরদেহ টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরে পাঠানো হয়।

23