বাংলাদেশ

কবে থামবে সীমান্তে নির্মমতা

নিজস্ব প্রতিবেদক   রংপুর

২৯ জানুয়ারী ২০২৪


| ছবি: 

সীমান্তে হত্যাকান্ডের ঘটনায় আবারো উদ্বেগ বাড়ছে। বিজিবি সদস্য হত্যার এক সপ্তাহের মাথায় লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আর এক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় আনতে ভারত সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও কেন তা সম্ভব হচ্ছেনা?  

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি নয়াদিল্লীতে গৃহকর্মীর কাজ করা ফেলানী সেদিন তার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরছিলো। সীমান্ত অতিক্রম করার সময়, ফেলানীর পোশাক কাঁটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার শুরু করে। ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী, বিএসএফ সেই চিৎকারের জবাব দেয় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে। সেখানেই ফেলানী মারা যায়। মধ্যযুগীয় কায়দায় তার প্রাণহীন দেহটি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
এই হত্যাকান্ড দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় তুললেও এক যুগ পরও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। উল্টো প্রধান আসামি বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ এবং তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিএসএফের নিজস্ব আদালত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হন।

হত্যার পাশাপাশি নির্যাতনের ঘটনাও কম নয়। ২০১৯ সালের ১০ মে সাতক্ষীরার কুশখালী সীমান্তে বিএসএফের হাতে নির্যাতনের শিকার হন কবিরুল ইসলাম। তার মুখ এবং পায়ুপথে পেট্রল দেয়া হয়েছিলো। এর ১৭ দিন পর ২৭ মে নওগাঁর শাপাহার সীমান্তে আজিমুদ্দিন নামের এক রাখালের ১০টি আঙুলের নখ তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা আবদুল জলিল বলেন,  বাংলাদেশ সরকরা আর ভারতের সরকার তো বুন্ধ হিসেব কাজ করে। তারপরও ভরতের সেনাবাহিনী আমাদের নিরপরাধ মানুষদের পাখির মতো  গুলিকরে মারে। আমাদের দেশে তো প্রশাসন  আছে, তারা কি আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আমরা আর কত এভাবে বিএসএফ এর হাতে মরব।

হরিপুর ইউনিয়নের জয়নাল মিয়া বলেন, বার্ডারের কাছে গেলে হুট করেই কোন কারন ছাড়া  আমাদের গুলি করে, অনেক সময় লাশটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় বিএসএফ। কয়েকদিন পর দেয় সেই লাশ। এরকম আর কত দিন চলবে আল্লাহ জানে।

অধিকার কর্মীরা মনে করেন, ফেলানী হত্যার বিচার পাওয়া গেলে সেটি সীমান্ত হত্যা নিরসনে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো।

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আব্রাহাম লিংকন বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকাই সীমান্তবর্তী। এখনো আমরা দেখতে পাই সীমান্তের অনেক এলাকায় আপন দুই ভাইয়ের বাড়ি দুদেশে। আর সীমান্ত রেখা উঠান বরাবর। এই পরিস্থিতিতে বার্ডরের কাছাকাছি গেলেই একজন মানুষকে গুলি করবে এটা কাম্য নয়। আবার নির্বিচারে গুলি করলেও সেই অপরাধের কোন শাস্তি হচ্ছে না। যে কারণে সীমান্তগুলোতে বিএসএফ নির্ভয়ে জেনারেল সিকিউরিটি ফর্সেস আইনের দোহাই দিয়ে মারছে মানুষ। তবে দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হলেও সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ করা দরকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে  বিএসএফের হাতে ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। অথচ ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে উভয় দেশ একমত হয়। 

এইচআরডাব্লিউ এর প্রতিবেদন বলছে , হত্যার ঘটনায় মামলার কোনোটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি যে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের  মানসিকতাই এর জন্য দায়ী। 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: কাজী রেজুয়ান হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারত স্বাধীনতা পর থেকে বন্ধু প্রতিম দেশ। বিদেশের পক্ষ থেকেই পারস্পরিক উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য আছে। দুই দেশের মধ্যেই চাওয়া সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতের যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আর বাংলাদেশে ভারতের যে সীমান্ত সম্পর্ক দুইটাকে মিলিয়ে ফেললে হবে না। মধ্যে একটা বৈরী সম্পর্ক বিরাজমান আর বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে একটা বন্ধু প্রতিম সম্পর্ক আছে। তাই সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ামতে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এর পাশাপাশি দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীদের মানসিকতারও পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি বলেন, শুধু বন্ধু দেশ বললেই হবেনা আচরণেও তার বহিঃপ্রকাশ থাকা দরকার।

25