বাংলাদেশ

বই গাছের ফেরিওয়ালা মাহমুদুল ইসলাম মামুন

জুলহাস উদ্দীন তেতুলিয়া   পঞ্চগড়

০৮ জুন ২০২৪


| ছবি: প্রতিনিধিঃ

দেশের সর্বউত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়ায় গাছ ও বই যার সফর সঙ্গী  মানুষের কাছে মামুন পরিচিত হয়ে উঠেছেন বই ও গাছের ফেরিওয়ালা হিসেবে। শিশুদের কাছে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা। পরিবেশের বন্ধু ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের আরেক পলান সরকার। পরিবেশ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই এ দিবসের লক্ষ্য। আর এই পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এ নিয়ে কাজ করেন তেঁতুলিয়ার তরুণ মাহমুদুল ইসলাম মামুন। প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই সাইকেলে বই, প্ল্যাকার্ড ও গাছ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন তিনি। ঘুরে বেড়ান তেঁতুলিয়ার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামে। মাহমুদুল ইসলাম মামুন তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামের আজহারুল ইসলামের ছেলে। তিনি কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর চাকরি পেছনে না ছুটে পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ব্যস্ত হয়ে যান প্রকৃতি ও মানবসেবায়। 
দুই দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করেন তিনি। এ সময় চার লাখের বেশি বিভিন্ন ফলের গাছ বিতরণ করেছেন তিনি। করোনার সময় বাড়িতে বাড়িতে ওষুধি গাছ ও ফল উপহার দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা দিয়েছিলেন। এসব করতে কারও কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নেননি তিনি। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষ করে যা আয় হয় তা দিয়েই বই, গাছ, সবজির বীজ বিতরণ করেন। 
জ্ঞানের আলো ছড়াতে নিজেই হয়ে উঠেছেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। পাঠকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বই দেন। বই পাঠ শেষ হলে দিচ্ছেন গাছের চারা উপহার। শিশু-কিশোরদের নিয়ে পাড়া মহল্লায় বসাচ্ছেন পাঠের আসর। এসব আসরে থাকেন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরাও। তারা শুনেন মামুনের বই পড়ার গল্প। মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, বিজ্ঞান ও বর্তমান প্রযুক্তিসহ নানান জ্ঞান সমৃদ্ধ বই। এ ছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে কোনো টাকা নেন না। এখন এলাকায় গড়ে তুলেছেন প্রকৃতি নামের এক পাঠাগার।
ফলজ গাছ দেওয়ার পাশাপাশি গৃহিণীদের মাঝে সবজির চারা ও বীজ বিতরণ করেন তিনি। বাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত জমিতে চাষ করতে লাউ, সিম, মরিচ ও বেগুনসহ নানান জাতের বীজের চারা দেন বাড়িতে বাড়িতে। বিষমুক্ত সবজি আবাদ করতে দিচ্ছেন নানান পরামর্শ। পরিবেশ দূষণ রোধে কাজ করছেন মামুন। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা প্লাস্টিক ও ময়লা সংগ্রহ করে রাখছেন নির্দিষ্ট জায়গায়। রাস্তার কোথাও কোনো গর্ত দেখলে নিজেই তা সংস্কার করেন। মাহমুদুল ইসলাম মামুন বলেন, প্রকৃতি আমাকে ছোটবেলা থেকেই টানতো। অনেক আগে থেকেই বাড়িতে গাছ লাগাতাম। ছাত্র জীবনে বুঝতে পারি আমরা নিজেরাই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। তাই তখন থেকে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে কাজ শুরু করি। দুই দশকের বেশি সময় ধরে মানুষকে বিনামূল্যে গাছ দিচ্ছি। এখন সেসব গাছ বড় হয়ে ফল দিচ্ছে। এটা আমাকে মানসিকভাবে শান্তি দেয়। তাছাড়া প্রকৃতিতে যদি গাছ না থাকে, তাহলে আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে বড় সমস্যায় পড়ে যাব। জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। আর এসব থেকে বাচঁতে গাছ বড় ভূমিকা রাখে।
তিনি আরও বলেন, সাহিত্যের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ থাকায় বই পড়া নেশা ছিল। বই জ্ঞানের আলো ছড়ায় এটা চিন্তা করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে বইয়ের পাঠক তৈরি করি। শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাঠের আসর বসাই। সেখানে শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে গাছ উপহার দেই। আমার স্বপ্ন দুষণমুক্ত এক পৃথিবীর গড়ার। 
মামুনের মা মাহমুদা বেগম বলেন, আমার ছেলে ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতিপ্রেমী। শৈশব থেকেই সে মানুষকে বিনে পয়সায় গাছ ও বিভিন্ন সবজির বীজ বিতরণ করে যাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারও চালাচ্ছে। এ কাজে শুরু থেকেই আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি।
স্থানীয় সরকারি কলেজের অবসর প্রাপ্ত  স্কাউট শিক্ষক বলেন, মামুন আমাদের গর্ব সে তরুণ যুবকের মধ্যে একজন কঠোর পরিবেশ বান্ধব । যেভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এ যুগে তা বিরল। অনেকেই হয়ত মামুনকে ‘পাগল’ মনে করে, কিন্তু সে পাগল নয়। মামুন পরিবেশ নিয়ে ভাবেন। পাড়া মহল্লায় ছোট ছোট বাচ্চাদের বিনামূল্যে পড়ান। এ যুগে এরকম যুবক মানুষ পাওয়া দুষ্কর। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দীন খান বলেন,তেঁতুলিয়া উপজেলায় একটি পরিবেশ বান্ধব ছেলে আছে সেটি হলো মামুন  সে  সকাল হলে  গাছের চারা ও বই নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষদেরকে গাছ লাগানো ও বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করে আমরাও তার কাজে উৎসাহিত করছি। মামুন পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন। পরিবেশের নিয়ে তার এ কাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চগড় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ইউসুফ আলী বলেন, মাহমুদুল ইসলাম মামুন একজন পরিবেশ বন্ধু। তিনি নিভৃতভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, পঞ্চগড় থেকে পরিবেশ পদক এর জন্য কয়েকবার তার নাম প্রস্তাব করেছি। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মান উন্নয়নে আমরা মাহমুদুল ইসলাম মামুনের কার্যক্রমকে সব সময় সাধুবাদ জানাই।

9