বাংলাদেশ

৪০ বছর পরে বীরের বেশে দেশে ফিরলেন নেপালী নাগরিক বীর বাহাদুর

নিজস্ব প্রতিবেদক   পঞ্চগড়

২৩ মে ২০২৪


| ছবি: প্রতিনিধিঃ

নেপালী নাগরিক বীর বাহাদুর রায়। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ষাট ছুঁইছুঁই। বাংলাদেশেই কেটেছে তার জীবনের দীর্ঘ ৪০টি বছর। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকায় নেপালী ভাষা ভূলে বাংলা ভাষা শিখে ফেলেন। বাংলা ভাষা এতটাই রপ্ত করেছেন যে বর্তমানে নেপালী ভাষায় কথা বলতে পারছেন না তিনি। এদিকে দীর্ঘ ৪০ বছর পরে দেশে ফিরছেন তিনি। স্বজনেরাও তাকে নিতে এসেছেন। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশনে আইনী প্রক্রিয়া শেষে বাংলাবান্ধা ও ভারতের ফুলবাড়ি সীমান্তে তাকে নিয়ে আসা হয়। এসময় বীর বাহাদূরের ভাতিজা রাজন চাচাকে কাছে পেয়ে বুকে জরিয়ে ধরেন। দীর্ঘদিন পরে স্বজনদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বীর বাহাদূর। পরে ভাতিজা রাজন চাচাকে উত্তরীয় ও টুপি পড়িয়ে দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করেন। পরে চাচা বীর বাহাদূরও ভাতিজার পা ছুঁয়ে সম্মান জানান। পরে রাজন দুপচাচিয়া এলাকার বাসিন্দা ফরেন, অলক সহ কয়েকজনের গলায় উত্তরীয় পড়িয়ে দেন।
পরে বীর বাহাদূরকে তার ভাতিজা রাজনের হাতে তুলে দেয়া হয়। এসময় বাংলাদেশে নিযুক্ত নেপালের উপ রাস্ট্রদুত ললিতা সিলওয়াল, সেকেন্ড সেক্রেটারি ইউয়েজানা বামজাম, নেপাল রাস্টদুতের সচিব রিয়া ছেত্রী, তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি,  বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমৃত অধিকারী, ভারতের ফুলবাড়ি ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজয় কুমার চৌধুরী, পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মেহেদী হাসান খান সহ তেতুঁলিয়া মডেল থানা পুলিশ ও বিজিবির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এসময় বীর বাহাদুরের হাতে নেপাল এম্বাসী ও বগুড়ার দুপচাচিয়ার স্থানীয় মানুষদের দেয়া আর্থিক সহযোগিতা তুলে দেয়া হয়। পরে ভারতীয় ইমিগ্রেশন পর্যন্ত বীর বাহাদুরকে এগিয়ে দেন নেপাল এম্বাসির সেকেন্ড সেক্রেটারি ইউয়েজানা বামজাম। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বীর বাহাদুর ছোটবেলা থেকে কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাসায় স্থির থাকতেন না তিনি। একপর্যায়ে ১৫ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। পরে ঘুরতে ঘুরতে অজান্তেই নেপাল থেকে ঢুকে পড়েন ভারতে। পরে সেখান থেকে সীমান্ত দিয়ে কখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন এখন কিছুই মনে নেই তার। এরই মাঝে প্রায় ১০ বছর কেটেছে সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট সহ উত্তরের কয়েকটি জেলায়। এসব জেলায় তিনি দিনমজুর, হোটেল শ্রমিকের কাজ করেছেন। পরে আবারো ঘুরতে ঘুরতে বগুড়া জেলার দুপঁচাচিয়া উপজেলার মাস্টার পাড়া এলাকায় চলে যান। সেখানেই কাটে তার জীবনের দীর্ঘ ৩০টি বছর। সেখানে তিনি অলক বসাক নামে এক ব্যাক্তির মিল চাতালে শ্রমিকের কাজ করেছেন। কাজের বিনিময়ে শুধু পেট পুড়ে খাবার চাইতেন। নিতেন না কোন টাকা পয়সা। তবে তার মধ্যে দেশে ফেরার টান ছিল। একপর্যায়ে স্থানীয়রা তার কাছে তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে গোরখে বাঙ্গিনা বললেও বিস্তারিত বলতে পারেন নি তিনি। অনেকে তাকে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দা মনে করেন। পরে তাকে নেপালী ভাষা লিখতে দিলে স্বাচ্ছন্দে লিখে ফেলেন তিনি। পরে দুপঁচাচিয়া মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান ফরেন বীর বাহাদূরের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন ঠিকানা জানতে চান। পরে স্থানীয় একটি গণমাধ্যেমে তাকে নিয়ে নিউজ হলে প্রশাসনিক ভাবে বীর বাহাদূরের ঠিকানা খুঁজতে নেপাল এম্বাসীতে তার ছবি দেয়া হয়। পরে দীর্ঘ সময় পরে নেপালের গোরখে বাঙ্গিনাতে তার পরিবারের কাছে ছবি দেখানো হলে তার বড় ভাবি বীর বাহাদূরতে চিনতে পারেন। পরে বীর বাহাদুরকে দেশে পাঠাতে শুরু আইনী প্রক্রিয়া। দীর্ঘ ৬ মাস পরে তাকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
বগুড়া জেলার দুপঁচাচিয়া পৌরসভার এলাকার বাসিন্দা পলক কুমার বসাক বলেন, বীর বাহাদূর দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে আমাদের মিল চাতালে কাজ করেছেন। কাজের বিনিময়ে শুধু খাবার খেয়েছেন কোন পারিশ্রমিক নেননি। আজকে তার পরিবারের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। তবে দীর্ঘ দিন আমাদের বাসায় থাকায় নিজের পরিবারের সদস্যর মত মনে করেছি। আজকে তাকে বিদায় দিতে এসে কান্নায় বুক ভেসে যাচ্ছে। তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের আমন্ত্রণ করেছেন তাদের দেশে যেতে। দেখি সুযোগ পেলে তাকে একবার দেখতে যাবো।
দুপঁচাচিয়া মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান ফরেন বলেন, আমি বীর বাহাদূরের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করি যাতে তাকে কোনভাবে দেশে পাঠানো যায়। যাক দীর্ঘ দিন পরে তাকে দেশে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।
নেপাল রাস্টদুতের সচিব রিয়া ছেত্রী বলেন, আমরা ফেসবুকে এক নেপালী নাগরিকের দেশে ফেরত যাওয়ার আকুতির জানানোর ভিডিও দেখতে পাই। পরে বগুড়ার দুপচাচিয়া থেকে বীর বাহাদুর নামে ওই ব্যাক্তির ছবি নিয়ে আমাদের এম্বাসির মাধ্যেমে আইনী প্রক্রিয়া শেষে দেশে ফেরত দেয়া হলো। তার স্বজনেরা তাকে নিতে এসেছেন। আমরা তার ভাতিজা রাজনের হাতে বীর বাহাদুরকে তুলে দিয়েছি। আমরা চাই তার জীবনের বাকি সময়টুকু কাটুক পরিবারের স্বজনদের সাথে।

38